3:07 PM মায়ের অপেক্ষা শেষে | |
মায়ের অপেক্ষা শেষে ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ রাত ১১.৩০
মুনার ক্লাসে মোটেই মন বসছেনা। মন বসছেনা তার কারণ রাজিয়া মিস। মুনা বেশ কিছুক্ষণ ধরে লক্ষ্য করছে আজও রাজিয়া মিসের পড়ানোয় খুব একটা মন নেই। তিনি ক্লাসে ঢুকলেন, চেয়ারে বসে ছাত্রীদের দিকে তাকিয়ে আবার হাজিরা খাতাটা খুলে বসলেন। পর পর তিন দিন হল মিসের মধ্যে এই পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। অথচ রাজিয়া মিসের মত প্রাণখোলা হাসি কেউ কখনো দিয়েছে কিনা তা মুনার মনে পড়েনা। হঠাৎ কি এমন হল যে মিসের মুখের সেই প্রাণ খোলা হাসি উবে গেল। হলিচাইল্ড একাডেমী থেকে ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পেয়ে মুনা গভমেন্ট গার্লস স্কুলে ক্লাস সিক্সে ভর্তি হয়েছিল। সেই ক্লাস সিক্স এর প্রথম দিন থেকেই রাজিয়া মিসকে ওর ভাল লেগে গেল। একদিনের কথা মুনা ভুলতে পারেনা। ক্লাস সিক্সে ভর্তি হওয়ার পর সপ্তাহ খানেক হয়নি এমন একদিন ও সবার আগে স্কুলে গেল। রাজিয়া মিস বারান্দায় দাড়িয়ে ছিলেন। মুনাকে ডেকে বললেন কি নাম তোমার? মুনার নামটা তার ভীষণ পছন্দ হয়েছে। মুনাও সাহস করে জিজ্ঞেস করলো মিস আমার নামটা কেন আপনার এতো পছন্দ? রাজিয়া মিসের খুব প্রিয় লেখক হুমায়ুন আহমেদ। তার লেখা প্রতিটি বই রাজিয়া মিস ধর্মীয় বইয়ের মত পড়ে। প্রিয় লেখকের একটা অসাধারণ বই আছে নাম কোথাও কেউ নেই। সেই বইয়ের কেন্দ্রীয় চরিত্র ছিল মুনা নামে একটা সাহসী মেয়ে। বইটা পড়তে গিয়েই মুনার প্রতি তার এতো ভালবাসা। তাই বাস্তবে কখনো মুনা নামে কাউকে পেলে তিনি ভীষণ খুশি হন। অথচ এর আগে কখনোই কোন মুনা নামের মেয়ের সাথে তার দেখা হয়নি। আর সে জন্যই সেদিন মুনাকে তিনি এতো আপন করে নিলেন যে বলার নয়। সেই থেকে মুনাও রাজিয়া মিসকে খুব ভালবাসে,শ্রদ্ধা করে। সেই প্রিয় মিস তিন চারদিন হল ঠিক মত হাসেনা,কথা বলেনা,ক্লাসে মন বসাতে পারেনা দেখে মুনারও মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। ক্লাসে হাজিরা ডাকতে ডাকতেই ঘন্টা পড়ে গেল। অথচ অন্য সময় মিস হাজিরা ডেকে আগের পড়া জিজ্ঞেস করে নতুন পড়া বুঝিয়ে দিতেন এমনকি দু একটা ছোট খাট গল্পও বলতেন কিন্তু ঘন্টা পড়তোনা আর আজ শুধু হাজিরা নাম ডাকতেই পুরো ঘন্টা পার। কিছু একটা হয়েছে যার কারণে মিসের মনটা হয়তো খুব খারাপ। জিজ্ঞেস করে জেনে নেয়া যেতে পারে। কিন্তু মিসের ব্যক্তিগত বিষয়ে প্রশ্ন করাকি ঠিক হবে? মুনা স্থির সিদ্ধান্ত নিতে পারেনা। অনেক ভেবে চিন্তে দেখলো মিস যেহেতু মুনা নামের মাঝে তলিয়ে গেছে সেহেতু প্রশ্ন করে জেনে নেয়া যেতে পারে কেন মিসের কোন কিছুতে মন বসছেনা। মিস নিশ্চই ওকে বলবে। বাকি ক্লাস গুলো শেষ হলে অন্য মেয়েরা হুড়মুড় করে স্কুল থেকে বেরিয়ে গেল। যেন কে কার আগে বাসায় পৌছাতে পারে তার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। মুনার অতো তাড়া নেই। মনে মনে ভেবে রেখেছে সে যে করেই হোক রাজিয়া মিসের সাথে কথা বলে তার মন খারাপ কেন বিষয়টা জানবে। পা টিপে টিপে টিচারস কমন রুমের দিকে এগিয়ে যায় মুনা। হেড মিস আগেই বাসায় চলে গেছে। জাহানারা মিস পত্রিকা হাতে খুটিয়ে খুটিয়ে রান্নার রেসিপি পড়ছে। মুনা দরজায় উকি দিল। পত্রিকা থেকে চোখ সরিয়ে জাহানারা মিস মুনার দিকে তাকিয়ে বললো কি চাই? জাহানারা মিস খুব রাগি। তার কথা শুনেই মুনার পিলে চমকে উঠলো। কোন মতে বললো না কিছু না রাজিয়া মিসের সাথে দেখা করতে চাই। জাহানারা মিস তেমন কিছু বললেননা। শুধু বললেন রাজিয়া মিসতো আগেই বেরিয়ে গেছে। আগেই বেরিয়ে গেছে! মুনার মুখে বিস্ময়। কারণ রাজিয়া মিস স্কুল ছুটি হওয়ার অন্তত আধা ঘন্টা পরে স্কুলের বাকি কাজ সেরে তবেই বাড়ি ফেরে। আর আজ কিনা স্কুল ছুটির ঘন্টা পড়তে না পড়তেই মিস বেরিয়ে গেছে। যেন তিনি মিস নন বরং একজন ছাত্রী। মুনা আর অপেক্ষা না করে বেরিয়ে পড়লো। অন্য সব মেয়েরে কখন বাসায় চলে গেছে। মুনাকে আজ একা একাই বাসায় ফিরতে হবে। ওর অবশ্য একা চলে অভ্যাস আছে। ছোট্ট শহরে কোন ব্যস্ততা নেই। ইচ্ছে হলেই রিক্সায় বাসায় ফেরা যায় তবে মুনার ইচ্ছে করেনা রিক্সায় চড়তে। আম্মু প্রতিদিন স্কুলে আসার সময় যাওয়া আসার জন্য রিক্সা ভাড়া দিয়ে দেয়। ওর এক মাত্র ভাইয়া কলেজে যাওয়ার সময় ওকে ওর স্কুলের সামনে নামিয়ে দিয়ে যায় বলে আম্মুর দেয়া রিক্সা ভাড়ার টাকাটা বেচে যায়। একবার দেখা গেল মুনা ওর ভাইয়ার রুমে এসে বললো ভাইয়া তোর পাশে একটু বসি। ঠিক আছে এখানে বস, বলে ভাইয়া তার হাতের সব কাজ ফেলে বোনের দিকে ফিরে বসলো। মুনার হাতে একটা খাম। ভাইয়ার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো ভাইয়া তুই এটা খুলে দেখ। ওর ভাইয়া ও কিছূ বললে উল্টো কোন প্রশ্ন করেনা। খামটা খুলে দেখলো সেখানে একুশটা দশটাকার নোট। ভাইয়া বলো এতোগুলো টাকা এখন কি করবি? অথচ তার প্রশ্ন করার কথা ছিল এতো টাকা তুই কোথায় পেলি? মুনা বললো ভাইয়া আজতো তোর কলেজ বন্ধ আমার স্কুলও বন্ধ এমনকি প্রাইভেটও নেই। চল এই টাকা দিয়ে দুই ভাই বোন আঞ্জুমান স্কুলের সামনের দোকান থেকে ফুসকা খেয়ে আসি। ভাইয়া বললো তাতো ঠিক আছে কিন্তু ফুসকা খেতেতো আর এতো টাকা লাগবেনা। বাকি টাকা কি করবি? মুনার সহজ উত্তর, ভাইয়া বাকি টাকা তুই রেখে দে। তুইতো এখন কলেজে পড়িস,তোরতো একটু বেশিই খরচ দরকার। আম্মু কখন কি দেয় না দেয়, আর তুইওতো গাধা আম্মুর কাছ থেকে একটা টাকাও চেয়ে নিসনা। কখনো বলিসও না আম্মু আমার পঞ্চাশ টাকা বেশি লাগবে। তোকে আম্মু যে কয়টাকা দেয় তাতে তোর হয়? আমিতো শুনেছি কলেজে পড়লে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে হয়,হাত খরচ হয়। তাই তুই টাকাটা রাখ,তোর অনেক কাজে দেবে। মুনার ভাইয়া কখনোই ওভাবে ভেবে দেখেনি। তার বোন তাকে কত ভালবাসে। নিজের খরচের টাকা একমাত্র ভাইকে দিয়ে কত কিছু বুঝিয়ে দিচ্ছে। টিচার্স কমন রুমে রাজিয়া মিসকে না পেয়ে মুনা ফুটপাথ দিয়ে হাটছে আর ভাবছে ভাইয়া নিশ্চই আজও ওকে নিয়ে যাওয়ার জন্য স্কুলের সামনে অনেকক্ষণ দাড়িয়ে থেকে চলে গেছে। আজ মুনার উচিৎ রিক্সায় করে তাড়াতাড়ি বাসায় ফেরা। তা না হলে ভাইয়া একা ফিরেছে দেখে আম্মু খুব চিন্তা করবে। এই ভেবে মুনা একটা রিক্সা নিল। বাসা খুব বেশি দূরে নয়। রিক্সায় গেলে দশ বার মিনিট লাগে। রিক্সা যখন আলিখোলা মোড়ে এসেছে ঠিক তখন মুনা অবাক হয়ে দেখলো রাজিয়া মিস কাধে ব্যাগ ঝুলিয়ে হাটছে। মুনা রিক্সা থামিয়ে মিসের পাশেই নেমে পড়লো। ওকে দেখে রাজিয়া মিস এই প্রথম কথা বললেন। কি ব্যাপার মুনা তুমি এখনো বাসায় যাওনাই? তোমার ভাইয়া তোমাকে নিতে আসেনি? মুনা বললো ভাইয়ার সাথেতো আমার দেখা হয়নি। ভাইয়া হয়তো আমাকে নিতে এসে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আমাকে না পেয়ে ফিরে গেছে। রাজিয়া মিস একটু আশ্চর্য হয়ে বললেন তোমাকে না পেয়ে ফিরে গেছে মানে? তুমি কোথায় ছিলে? মুনা বললো মিস আমি আসলে আপনাকে খুজছিলাম। সারা স্কুল খুজেছি,টিচার্স কমন রুমে খুজেছি কিন্তু আপনি নেই। তাই এতো দেরি হয়েছে আর ভাইয়া আমাকে না পেয়ে মন খারাপ করে ফিরে গেছে। মিস বললেন আমাকে কেন খুজছিলে? তোমার কোন দরকার? না না না মিস আসলে আমার কোন দরকার না, আমার মনটা খুব খারাপ! কি বলছো মুনা তোমার মন খারাপ? কেন মন খারাপ? আমাকে বলো। মুনা একটু ভেবে নিয়ে বললো মিস আসলে আমার মন খারাপ আপনার জন্য। আমি লক্ষ্য করলাম গত তিন দিন হলো আপনি কেমন যেন হয়ে গেছেন। ঠিক মত ক্লাস নিচ্ছেননা,আপনার মুখ থেকে সেই চির চেনা হাসি মিলিয়ে গেছে। কোন কিছুতেই আপনাকে আকর্ষণ করছেনা তাই আপনার জন্য আমার মন খারাপ। মিস আমিতো খুব ছোট তাই আমার মনটাও খুব নরম। খুব কষ্টের না হলে আমাকে বলবেন আপনার কি হয়েছে। আপনার যদি কোন অসুখ হয় তাও বলেন। আমার মামা বড় ডাক্তার। আপনি রানা মামার নাম শোনেননি? ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রফেসর। অনেক নামকরা ডাক্তার।
উনি আমার আপন মামা। আমি মামাকে বলবো আর মামা আপনার অসুখ সারিয়ে দেবেন। মুনার কথা শুনে রাজিয়া মিস একটু খানি হাসলেন। হঠাৎ করেই যেন তার মন ভাল হয়ে গেল। কিন্তু পরক্ষনেই মুনা দেখলো রাজিয়া মিসের চোখ জলে ভরে গেছে এবং মিনিটের ব্যবধানে ঝর ঝর করে তিনি কেদে ফেললেন। আসে পাশে কেউ নেই। একজন স্কুলের মিস রাস্তায় এভাবে কাদছে দেখলে লোকে কি না কি মনে করে। কিন্তু তার চেয়ে বড় কথা হলো রাজিয়া মিস মুনাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে কাদছে। যেন ছোট্ট শিশুটি কোন বড় মানুষের কোলে মাথা রেখে কাদছে। মুনার এখন কি করা উচিৎ? মুনারও ইচ্ছে হচ্ছে মিসের সাথে গলা ফাটিয়ে কাদে। কিন্তু মুনা কাদতে পারেনা। মিসই একদিন বলেছিল মুনাকে উপন্যাসের মুনার মত শক্ত হতে হবে। কোন অবস্থাতেই ভেঙ্গে পড়লে চলবেনা। রাজিয়া মিসই কথাগুলো বলেছিল। এখন যদি রাজিয়া মিসের সামনেই সে কাদে তাহলে ব্যাপারটা অন্যরকম হয়ে যাবে। মুনা কয়েক মিনিটের জন্য বড় মানুষ হয়ে গেল। মিসের চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বললো মিস দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে। অথচ মুনা জানেইনা যে আসলে মিসের কি হয়েছে,কেন কষ্ট পাচ্ছে। আসলে পড়াশোনা আর গল্প শোনার বাইরে মুনা কখনোই রাজিয়া মিসের বিষয়ে কিছু জানতো না। মুনার কথা শুনেই কিনা রাজিয়া মিস কিছুটা শান্ত হলেন। তিনি আসলে ভাবতেই পারেননি যে তার কষ্টে কেউ কষ্ট পাচ্ছে তার জন্য কেউ ভাবছে। আর সেটা যে মুনার মত ছোট্ট একটা মেয়ে এটা ভেবে তিনি আরও বেশি আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়েছেন। তিনি মুনার হাত ধরে নিজের বাসায় নিয়ে গেলেন। মিসের বাসায় এসে তার মনটা খারাপ হয়ে গেল। মিসের কথা নাহয় শুনবে কিন্তু বাসায় ভাইয়া আম্মু মুনাকে না পেয়ে অস্থির হয়ে পড়বে। হয়তো এরই মাঝে চারদিকে খোজ নিতে শুরু করেছে। ওকে চিন্তিত দেখে রাজিয়া মিস বললেন তোমাকেওতো এখন খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে। মুনা বললো মিস আমার ভাইয়া আম্মু আমি ফিরছিনা দেখে অস্থির হয়ে যাবে। হয়তো এতোক্ষণে নিশ্চই খুজতে শুরু করেছে। আমার বোধহয় বাসায় চলে যাওয়া উচিত। রাজিয়া মিস বিষয়টা অনুভব করে ওকে বললেন ঠিক আছে আমার ফোন থেকে ফোন করে বলে দাও তুমি আমার সাথে এসেছ। আর আমি সন্ধ্যার আগেই তোমাকে তোমাদের বাসায় পৌছে দিয়ে আসবো। মিসের কথা শুনে মুনার মন ভাল হয়ে গেল। ভাইয়ার নাম্বারে ফোন করতেই ভাইয়া সালাম দিয়ে বললো কে বলছেন? মুনার ইচ্ছে হল ভাইয়ার সাথে একটু দুষ্টুমী করি। তাই বললো আপনিকি জাহিদ বলছেন? ভাইয়া বললো হ্যা বলছি আপনি কে? মুনা কন্ঠটাকে যথাসম্ভব গম্ভীর করে বললো আমি কে সেটা জানার দরকার নেই শুধু শুনে রাখুন কেমন ভাই আপনি যে বোনকে স্কুল থেকে নিয়ে যেতে পারেননা। আপনার বোন এখন কোথায় কি অবস্থায় আছে জানেন? মুনার এ কথা শুনে ভাইয়া প্রায় থতমত খেয়ে গেলে। আমতা আমতা করে বললো আমি ওকে আনার জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছি। পরে ওকে না পেয়ে ফিরে এসেছি। ভেবেছিলাম বান্ধবীদের সাথে ও বাসায় চলে এসেছে। বাসায় ফিরে দেখি ও আসেনি। আম্মু আমাকে ভীষণ ভাবে শাষিয়েছে। বলেছে ছোটে বোনটাকে একটু ভালবাসতে শেখো,এতো বড় হয়েছ আর বোনের প্রতি তোমার দায়িত্ব কতটুকু তা বুঝতে পারোনা। এখন আমি আমার বোনটাকে কোথায় পাই। ওকে না পেলে রাতে আমি ভাত খাব কি করে? ভাইয়ার এরকম অবস্থা দেখে মুনার বেশ হাসি পাচ্ছিল। তবে কষ্টও হচ্ছিল,ওর জন্য ভাইয়া কত বকুনি খেয়েছে। ও কথায় গাম্ভির্য এনে জানতে চাইলো বোন ফিরে না আসলে আপনি রাতে ভাত খেতে পারবেননা কেন? মুনার ভাইয়া বললো আমি ওকে ছাড়া কখনো খেতে পারিনা। প্রথমে ও আমার মূখে একবার তুলে খাইয়ে দেয় তার পর আমি খাই। আমি আমার বোনটাকে খুব ভালবাসি। ভাইয়ার কথা শুনে মুনার খুব খারাপ লাগলো। বললো আরে গাধা আমি তোর বোন মুনা। আমার কন্ঠ চিনতে পারছিসনা? এবার ভাইয়ার উত্তেজনাটা বোঝা গেল। মুনা তুই সত্যি তুই? তুই এখন কোথায়? তোর জন্য আম্মু আমি কি চিন্তা করছি জানিস? তুই কিছু না বলে কোথায় কি করছিস? বল কোথায় আছিস আমি এক্ষুনি আসছি। মুনা বললো ভাইয়া তুই আম্মুকে চিন্তা করতে নিষেধ কর আর বল আমি স্কুল থেকে রাজিয়া মিসের সাথে ওনার বাসায় এসেছি। মিস বলেছে সন্ধ্যার আগেই আমাকে বাসায় পৌছে দেবে। আমি তোকে বলে আসতে পারিনি বলে ক্ষমা চাচ্ছি। এতোটুকু বলেই মুনা ফোন রেখে দিল। কিন্তু মুনা জানে কিছুক্ষণের মাঝেই ওর ভাইয়া মিসের বাসার সামনের রাস্তায় পায়চারি করবে। মিসের বাসার সামনে হাটাহাটি করলেও কেউ অবশ্য কিছু বলবেনা। কারণ কম বেশি শহরে ছোট বড় সবাই মুনার ভাইয়াকে চেনে। স্থানীয় পত্রিকায় মাঝে মাঝেই ভাইয়ার ছবি ছাপা হয়। ভাইয়ার একটা ব্যান্ড দল আছে নাম আলোরমেলা। এ ছাড়াও ভাইয়া বেশ ভাল কবিতা লেখে। সেসব কবিতা নিয়মিত ছাপা হয়। আর ভাইয়া যখন আঞ্জুমান স্কুলে পড়তো তখন যে কোন প্রতিযোগিতায় ভাইয়া হয় ফাস্ট নয়তো সেকেন্ড হতো। স্থানীয় পত্রিকায় তখন থেকেই ভাইয়া ছবি ছাপা হতে হতে এখন সে সবার কাছে চেনা জানা হয়ে গেছে। এর পর যখন সরকারী কলেজে ভর্তি হল তখন সে ক্রিকেট টিম খুললো। সেটার নামও দিল আলোরমেলা। এখন তাই আলোরমেলা আমাদের শহরে একটা ব্রান্ড হয়ে গেছে। সবাই জানে আলোরমেলার অন্যতম সদস্যা মুনার ভাইয়া । সন্ধ্যা হতে এখনো প্রায় ঘন্টা তিনেক বাকি। এর মাঝেই রাজিয়া মিসের সাথে সব কথা শেষ করতে হবে। মুনা মিসের বাসায় ঢুকে একটা সোফায় বসলো। সামনে টিটেবিলের ওপর স্কুল ব্যাগ নামিয়ে রাখলো। এর আগে কখনো মুনা রাজিয়া মিসের বাসায় আসেনি। বাসাটা বেশ সাজানো গোছানো। কিন্তু একটু নিরিবিলি। মনে হয় কোথাও কেউ নেই।
মিসের হাজবেন্ড,মিসের ছেলে মেয়ে কে কোথায় আছে তাও মুনা জানেনা। ড্রয়িং রুমের পশ্চিম পাশে একটা বুকশেলফ। সেখানে স্তরে স্তরে সাজানো হুমায়ুন আহমেদ,আনিসুল হক আর জাফর ইকবাল সহ দেশী বিদেশী অনেক লেখকের বই। মুনার মনে হল পুরো পৃথিবীর সব বই বোধ হয় রাজিয়া মিসের বাসায়। রাজিয়া মিস ওকে ড্রয়িং রুমে বসিয়ে রেখে ভিতর রুমে গেছেন। অবশ্য ওকেও যেতে বলেছিল কিন্তু মুনা ড্রয়িংরুমে বসতেই আগ্রহ দেখালো। মুনা ঘুরে ঘুরে আলমারির সব বই দেখলো। আলমারিটা খোলাই ছিল। সেখান থেকে সে একটা বই বের করলো। বইটার নাম মা। লেখক আনিসুল হক। মিসের ফিরে আসতে আসতেই মুনা প্রায় দশ পৃষ্ঠা পড়ে ফেললো। অসাধারণ লেখা। যেন বই নয় বাস্তব কিছু। এর মাঝে রাজিয়া মিস একটা নীল পেড়ে জর্জেট শাড়ী পরে ফিরে এলেন। মিসের বয়স ৫২ বা তার কিছু বেশি। কিন্তু দেখে কখনো তা মনে হয়না। আর নীল পেড়ে শাড়ী পরার কারণে মিসকে দেখে মনে হচ্ছে ভাইয়ার সাথে ভাইয়ার কলেজে পড়ে। মিস জানতে চাইলেন শাড়ীটাতে তাকে কেমন মানিয়েছে। মুনার এ ব্যাপারে কোন ধারণা নেই। তার পরও বললো মিস আপনাকে খুব সুইট লাগছে! শুনে মিস আগের মত মিষ্টি হাসি দিলেন। সোফায় বসতে বসতে রাজিয়া মিস মুনার দিকে তাকাতেই ওর হাতে আনিসুল হকের মা বইটার দিকে নজর পড়লো। তিনি বললেন এটি একটি অসাধারণ বই। এই বইটা আমি জীবনে কতবার যে পড়েছি তার কোন শেষ নেই। যতবার পড়ি ততোবারই কাদি। সত্যিকার কাহিনী নিয়ে অসাধারণ প্রতিভাধর আনিসুল হক এই বইটি লিখেছেন। এই বইটি বাংলা সাহিত্য ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। বইটা পড়লেই আজাদের কথা আর আজাদের মায়ের কথা মনে পড়ে। মনে হয় এখনই ছুটে যাই জুরাইনের কবর স্থানে। গিয়ে আজাদের মাকে জাগিয়ে তুলি। জিজ্ঞেস করি আপনি কেমন করে এতো কষ্ট সহ্য করেছেন? মুনার খুব জানতে ইচ্ছে হয় বইটা সম্পর্কে। রাজিয়া মিস নিজেই সংক্ষেপে বইটি সম্পর্কে বলেন। সেই সাথে মুনাকে বলেন বইটা তুমি নিয়ে যাও। স্কুলের পড়ার অবসরে আস্তে আস্তে পড়ে শেষ করো। মুনার খুব ভাল লাগে। টি টেবিলের ওপর একটা গ্লাসে পানি আর একটা প্লেটে আঙ্গুর,আপেল এবং কমলা লেবু কাটা। মুনার দিকে সেটা বাড়িয়ে দিয়ে নিজেও এক পিস আপেল নিয়ে রাজিয়া মিস বলতে শুরু করলেন। মুনা যে কথা গুলো শোনার জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে বসেছিল। রাজিয়া মিসের স্বামী মারা গেছেন অনেক দিন আগে। একমাত্র সন্তানকে নিয়ে তার দিন কাটছিল বেশ ভালই। সরকারী কলেজে পড়তো তার একমাত্র ছেলে সাগর। সাগর যখন বেশ ছোট তখন সাগরের বাবা মারা যান। তার পর থেকে রাজিয়া মিস অনেক কষ্টে সাগরকে বড় করে তোলেন। এইচ এস সি পরিক্ষা দিয়ে সাগর স্কলারশীপের আবেদন করতেই অস্ট্রেলিয়াতে পড়তে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে গেল। মিসের কিছুটা মন খারাপ হলেও ছেলে বিশ্ব বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাচ্ছে ভেবে খুব খুশি হলেন। একদিন সত্যি সত্যি সাগর অষ্ট্রেলিয়া চলে গেল। রাজিয়া মিস একা হয়ে পড়লেন। তিনি স্কুলের ছাত্রীদের নিয়ে আনন্দে মেতে থাকার চেষ্টা করতেন। রোজ অবশ্য ছেলের সাথে কথা হতোনা। তবে এক দুই দিন পর পর ছেলে তাকে ফোন করতো। একমাত্র ছেলে সাগর ছিল তার ছেলে,বাবা কিংবা বন্ধু সবই। এভাবেই চার বছর দেখতে দেখতে কেটে গেল। সাগরের বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ হলো। মাকে জানালো সেপ্টেম্বরের বাইশ তারিখ দেশে ফিরছে। রাজিয়া মিসের তখন আনন্দ আর ধরেনা। তিনি পরিপাটি করে বাসা সাজালেন। কত দিন পর তার একমাত্র ছেলে দেশে ফিরছে। ছেলের যা কিছু পছন্দ ছিল সে মত সব ব্যবস্থা করলেন। রাজিয়া মিসের কোন ভাইবোন ছিলনা। বাবা মা গ্রামে থাকতেন কিন্তু তারা এতোই বৃদ্ধ আর রোগাগ্রস্থ যে রাজিয়া মিসের ছেলে দেশে ফিরছে জেনেও তারা আসতে পারলোনা। শেষে মিস একাই ঢাকা আসলেন। উত্তরার আজমপুর রেল লাইনের ওখানে রাজিয়া মিসের মামাতো ভাইয়ের বাসা। তিনি একদিন আগেই এসে ওখানে উঠলেন। যেদিন তার একমাত্র ছেলে সাগর ফিরছে সেদিন সকালেই তিনি এয়ারপোর্ট চলে গেলেন। যাওয়ার সময় এক গোছা ফুলও নিয়ে গেলেন। বিদেশ থেকে কেউ ফিরলে তাকে ফুল দিয়ে স্বাগত জানাতে হয়। যথারীতি রাজিয়া মিস তার ছেলের জন্য অপেক্ষা করছেন। আরো কত মানুষ তাদের প্রিয়জনের জন্য ফুল নিয়ে অপেক্ষা করছে তার হিসেব নেই। সাগর বিমান থেকে নেমেই মাকে ফোন করলো। আম্মু আমি বাংলাদেশের মাটিতে পা রেখেছি, তুমি কোথায়? রাজিয়া মিস যেন সেদিন আবেগ ধরে রাখতে পারছিলেননা। তিনি আনন্দিত গলায় বললেন বাবা আমি তোর জন্য রিসিভিং এরিয়াতে অপেক্ষা করছি। কথা শেষ করে সাগর ফোন রেখে দিল। রাজিয়া মিস যখন তারএক মাত্র ছেলেকে রিসিভ করার জন্য ফুল হাতে অপেক্ষা করছে ঠিক তখন আরো অনেক মানুষের মত এক মধ্য বয়স্ক মহিলাও কারো না কারো জন্য ফুল হাতে অপেক্ষা করছিল। রাজিয়া মিস দেখলেন তার ছেলে সাগর বাইরে বেরিয়েছে। ছেলেটা কত সুন্দর হয়েছে আর কত স্মার্ট লাগছে দেখে নিজের কাছেই খুব গর্ব হচ্ছে। তার এতো দিনের স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে। তার ছেলেকে বিয়ে দিয়ে ঘরে টুকটুকে একটা সুন্দর বউ আনবে আর তার নিঃসঙ্গতা কেটে যাবে। রাজিয়া মিস ছেলেকে দেখে হাত নাড়ালেন। তার একমাত্র ছেলে সাগর ও তাকে দেখে হাত নাড়ালো। মনে ভিতর আনন্দ আর ধরেনা। কতদিন পর তার ছেলেটা দেশে ফিরছে। ছেলেটা খুব কাছে আসলো। রাজিয়া মিস হাত বাড়িয়ে দিলেন যেন ছেলেটা মায়ের বুকে আশ্রয় নিয়ে অনেক দিনের শুন্য বুকটাকে শান্তিতে ভরিয়ে দেয়। কিন্তু রাজিয়া মিসের বুকটা হাহাকার করে উঠলো যখন দেখলেন তার ছেলে তার বুকে নয় বরং পাশে ফুল নিয়ে দাড়ানো অর্ধ বয়স্ক মহিলার বুকে মাথা রেখেছে। মা বলে জড়িয়ে ধরেছে। রাজিয়া মিস তার পাশে গিয়ে বাবা সাগর উনি নয় আমি তোর মা। আমাকে চিনতে পারছিসনা? সাগর নামের ছেলেটা তার মাকে বললো মা উনি কে? রাজিয়া মিস যেন আকাশ থেকে পড়লেন। নিজের ছেলে তাকে চিনতে পারছেনা? হঠাৎ মনে হলো এ ছেলে হয়তো অন্য কেউ। তার ছেলেতো একটু আগে ফোন করেছে যে সে বাংলাদেশের মাটিতে ল্যান্ড করেছে। সে নিশ্চই এখনো বেরিয়ে আসেনি। কি মনে করে রাজিয়া মিস একটু থামলেন। তার পর ভাবলেন সে কি নিজেই নিজের ছেলেকে চিনতে পারছেনা? ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করে ছেলেকে ফোন করলেন। ছেলে ফোন রিসিভ করেবরাবরের মতই বললো হ্যালো আম্মু তুমি কোথায়? রাজিয়া মিস যেন হাফ ছেড়ে বাচলেন। তার ছেলে তারই আছে। তিনি জানালেন তিনি বাইরেই অপেক্ষা করছেন। আগের ছেলেটির দিকে ফিরে তাকিয়ে দেখলেন ছেলেটা কথা বলছে। তিনি কথা বন্ধ রেখে মোবাইল কানে দিয়েই ছেলেটির দিকে এগিয়ে গেলেন সে কি কথা বলছে তা শোনার জন্য। তিনি ভীমরি খেলেন। ছেলেটা মোবাইলে যা কথা বলছে সেটাই তার কানে ধরা মোবাইলে শোনা যাচ্ছে। তিনি ফোন রেখে বললেন বাবা আমি তোর মা তুই আমাকে চিনতে পারছিসনা কেন? ওনারসাথে আছিস কেন? সাগর নামের ছেলেটা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলো। আবারও বললো আম্মু উনি কেন বলছেন যে উনি আমার মা। সেই মা বললো জানিনা বোধহয় ওনার মাথায় সমস্যা। রাজিয়া মিস রেগে যাচ্ছিলেন তারপরও কিছু বললেন না। ঠিক এমন সময় আরো ট্রাজিক ঘটনা ঘটলো। সাগরের বয়সী আরেকটা ছেলে তাদের সামনে এসে দাড়াল। সেও অস্ট্রেলিয়া থেকে পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরেছে। রাজিয়া মিসের ছেলেকে যে নিজের ছেলে মনে করে বুকে টেনে নিয়েছে এমনকি রাজিয়া মিসের ছেলেও যাকে নিজের মা মনে করছে পরে আসা ছেলেটা তাকে জড়িয়ে ধরে বললো আম্মু কেমন আছ? কত দিন পর তোমাকে দেখছি। অর্ধ বয়স্ক মহিলা অস্বস্থি সহকারে নিজেকে ছড়িয়ে নিয়ে বললো এই ছেলে তুমি কে? ছেলেটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। সে বললো আম্মু আমি তোমার একমাত্র ছেলে সাগর! রাজিয়া মিস চমকে উঠলেন। এই ছেলেটার নামও সাগর! অর্ধ বয়স্ক মহিলা বললেন তোমাকেতো আমি চিনিনা! আমার ছেলে সাগরতো আমার পাশেই দাড়িয়ে আছে। বলেই রাজিয়া মিসের ছেলে সাগরকে তিনি বুকে টেনে নিলেন। পরে আসা ছেলেটা প্রথমে ভেবেছিল মা হয়তো দুষ্টুমী করছে কিন্তু অন্য ছেলেটাকে বুকে টেনে নিতে দেখে সে থমকে গেল। রাজিয়া মিসের দিকেও খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে সে আগের ছেলেটিকে প্রশ্ন করলো এই তুমি কে? আমার মায়ের সাথে কেন? সে বললো তোমার মা মানে! আমি আমার আম্মুর সাথে আছি তাতে তোমার কি। চলো আম্মু বাসায় চলো বলেই সে মাকে নিয়ে চলে গেল। রাজিয়া মিস নির্বাক হয়ে গেলেন সেই সাথে পরে আসা ছেলেটিও। কিছুক্ষণ দুজনে কিছুই বলতে পারলোনা। পরে আসা ছেলেটাই প্রথম কথা বলে উঠলো। আন্টি আপনার চোখে জল কেন? আপনি কেন কাদছেন? কাদারতো কথা আমার। বিদেশ থেকে পড়াশোনা করে কতদিন পর দেশে ফিরলাম আর এখন দেখি নিজের মা ই আমাকে চিনতে পারছেনা! এর চেয়ে কষ্টের আর কি থাকতে পারে। ইচ্ছে হচ্ছে এখনই আবার চিরদিনের জন্য অস্ট্রেলিয়া ফিরে যাই। ওর কথা শুনে রাজিয়া মিসের চোখ জলে ভরে উঠলো। ছেলেটা আরেকটু কাছে এসে বললো আপনার কি হয়ছে? রাজিয়া মিস হাতের তালু দিয়ে চোখ মুছে ওকে জানালো যে তোমার মা যে ছেলেটাকে নিজের ছেলে হিসেবে বাসায় নিয়ে গেল সেই ছেলেটাই আমার একমাত্র ছেলে। তোমার মা যেমন তোমাকে চিনতে পারেনি আমার একমাত্র ছেলেটাও তেমনি আমাকে চিনতে পারেনি। তোমার চেয়ে আমার দুঃখ কম কিসে বলো? এই ছেলেটার নামও সাগর। রাজিয়া মিসের কথা শুনে তার মনটা কিছুটা ভাল হয়ে গেল। রাজিয়া মিস তাকে জিজ্ঞেস করলেন তুমি এখন কোথায় যাবে,কোথায় উঠবে? সাগর জানালো এই পৃথিবীতে একমাত্র মা ছাড়া তার আর কোন আত্মীয় স্বজন কোথাও কেউ নেই। সাগরের জন্য রাজিয়া মিসের খুব মন খারাপ হয়ে গেল। পৃথিবীতে এত কেন দুঃখী মানুষ। সাগর জানালো রাতটা কোন হোটেলে কাটিয়ে কালকের ফ্লাইটেই সে ফিরে যাবে। রাজিয়া মিস কোন কথা বললেননা। তিনি নিরবে হেটে চলে আসলেন। সাগর নামের ছেলেটিও হাটতে হাটতে ওয়েটিং রুমের দিকে যেতে লাগলো। রাজিয়া মিস আর ছেলেটির দূরত্ব প্রায় মিলিয়ে যাওয়ার কাছাকাছি এমন সময় রাজিয়া মিস ফিরে তাকালেন এবং ছেলেটিকে ডাকলেন সাগর! সেই ডাক শুনে সাগর থমকে দাড়াল। যেন এই কন্ঠটা তার চিরকালের চেনা। কেমন একটু মায়া মায়া জড়ানো। বুকের ঠিক মাঝ খানে এসে বিধে। সে ফিরে তাকালো এবং রাজিয়া মিসকে দেখতে পেল। রাজিয়া মিস হেটে হেটে তার দিকে আসছে। সেও কিছুটা এগিয়ে আসলো। কাছা কাছি আসতেই রাজিয়া মিস সাগর নামের ছেলেটির হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে কোমল অথচ কষ্টে ভেঙ্গে যাওয়া হৃদয়ে বললেন তুমি ফিরে যেওনা। তুমি ফিরে গেলে আমি আমার ছেলেকে আর কোন দিন ফিরে পাবনা। কিন্তু সাগর থাকবেইবা কোথায়। রাজিয়া মিস বললেন তার ছেলে যেহেতু ও বাসায় চলে গেছে তাই এই সাগর যদি রাজিয়া মিসের বাসায় থাকে কোন সমস্যা হবেনা। তারপর দুজনে মিলে কিছু একটা করা যাবে। এই কথা মত সাগর রাজিয়া মিসের বাসায় এসে উঠলো। রাজিয়া মিস তাকে নিজের ছেলে সাগরের মতই আদর যত্ন করলো। দুজন মিলে অনেক চিন্তা করলো কিন্তু কোন সমাধান খুজে পেলনা। এর মাঝেই দু তিনবার রাজিয়া মিসের ছেলে তাকে ফোন করে বলেছে আম্মু তুমি কোথায়,তোমাকে সকাল থেকে দেখছিনা কেন? এ কথা শুনেই রাজিয়া মিস সাগর টু কে সাথে নিয়ে ছুটে গেছে ওদের বাসায়। কিন্তু সামনে আসলেই আর রাজিয়া মিসের ছেলে তাকে চিনতে পারছেনা। ঠিক একই ঘটনা ঘটছে সাগরের বেলাতেও। তার মাও তাকে ফোন করে বলছে বাবা তুই কোথায়,সকালে নাস্তা করে বেরিয়েছিস দুপুরে খাবার সময় হয়ে গেল অথচ তোর কোন খোজ নেই। রাজিয়া মিসের মত সেও দৌড়ে হাজির হচ্ছে কিন্তু সামনে আসলে মা তাকে চিনতে পারছেনা। রাজিয়া মিসকে সে এখন মা বলেই ডাকছে। নিজের মা যে মায়ের ছেলেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে সেই মাকে মা ডেকে সাগর কিছুটা হালকা হতে চায়। ঠিক একই ভাবে রাজিয়া মিসও সাগরের মা ডাক শুনে নিজের ছেলের মত তাকে ভালবাসে। কারণ তার ছেলেতো এই ছেলেকে মায়ের আদর থেকে বঞ্চিত করছে। এভাবেই কেটেছে গত দুটোদিন। বড় বড় ডাক্তারের সাথে কথা হয়েছে তারা বলেছে ওই ভদ্র মহিলা ও রাজিয়া মিসের ছেলে সাগরকে চেম্বারে নিয়ে যেতে। কিন্তু তাদেরকে কি করে ডাক্তারের কাছে নেবে। তারাতো ওদের পাত্তাই দেয়না। সে জন্যই রাজিয়া মিস এতোটা ভেঙ্গে পড়েছেন। কোন কিছুতেই মন বসছেনা। রাজিয়া মিসের সব কথা শুনে মুনার খুব মন খারাপ হল। দুনিয়াতে মানুষের এতো কষ্টও থাকে তা তার জানা ছিলনা। রাজিয়া মিসের কথা শুনতে শুনতে বার কয়েক জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়েছে। মুনা দেখেছে সত্যি সত্যি তার ভাইয়া রাস্তায় পায়চারি করছে। মুনা মিসকে বললো মিস আপনার কষ্টের কথা শুনে আমি ও খুব কষ্ট পেলাম। দোয়া করি আপনার সব দুঃখ শেষ হয়ে যাক। আজ আমাকে যেতে হবে। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। রাজিয়া মিস বললেন চলো আমি তোমাকে বাসায় পৌছে দিচ্ছি। মুনা বললো আপনাকে যেতে হবেনা মিস। রাজিয়া মিস বললেন তা কি করে হয়। তুমি ছোট্ট একটা মেয়ে এই সন্ধ্যার সময় একা একা বাসায় ফিরবে এটা ঠিকনা।মুনা বললো আমি একা ফিরবোনা আমার ভাইয়া অনেক ক্ষণ থেকে আমাকে নেয়ার জন্য নিচেয় অপেক্ষা করছে। মুনা আঙ্গুল দিয়ে বাইরে দেখাল। রাজিয়া মিস দেখলেন একটা কলেজ পড়ুয়া ছেলে পায়চারি করছে। তিনি সিড়ি দিয়ে মুনাকে নিয়ে নিচে নেমে এলেন। মুনাকে বললেন তোমার ভাইয়া তোমাকে খুব ভালবাসে দেখেই বোঝা যায়। মুনা বললো আমার ভাইয়া আমাকে একটু একটু ভালবাসে। মিস হেসে দিয়ে বললেন পৃথিবীর সব ভাই তার বোনকে তোমার ভাইয়ার মত একটু একটু ভালবাসলেই সবাই খুশি। গেট দিয়ে বের হওয়ার সময় একটা ছেলের সাথে মুনার দেখা হলো। রাজিয়া মিসকে দেখে ছেলেটি বললো আম্মু তুমি কি আবার কোথাও যাচ্ছ? রাজিয়া মিস মুনাকে দেখিয়ে দিয়ে বললো কোথাও যাচ্ছিনা শুধু ওকে একটু এগিয়ে দিচ্ছি। মুনার বুঝতে বাকি থাকলোনা এই ছেলেটাই দ্বিতীয় সাগর। যার মা রাজিয়া মিসের ছেলে সাগরকে নিজের ছেলে হিসেবে নিয়ে গেছে। মুনা আর ওর একমাত্র ভাইয়া একটা রিক্সায় উঠে বসেছে। দশ বার মিনিট লাগবে বাসায় পৌছাতে। ভাইয়াকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে আদুরে গলায় মুনা বললো ভাইয়া তুই কি খুব রাগ করেছিস আমার ওপর? ভাইয়া বললো নাহ তোর ওপর রাগ করে থাকা কি আমার পক্ষে সম্ভব? আমি একটুও রাগ করিনি। মুনা বললো তাহলে যে আমার জন্য আম্মু তোকে বকলো। তুই এতে কষ্ট পাসনি? ভাইয়া বললো আমি আমার বোনের জন্য বকা খেয়েছি অন্য কারো জন্যতো নয়। আমি চাই আমার বোন যে কোন মূল্যে ভাল থাক। আম্মুর কাছে একটু আধটু বকা খাওয়া ভাল! ছোট খাট কথা বলতে বলতেই বাসার সামনে এসে রিক্সা থামলো। বাসায় যাওয়ার পরও আম্মু কিছু বললোনা। আম্মু কিছু বলেও লাভ নেই। আম্মু যতোই রাগ করুক না কেন সেটা মুনা পর্যন্ত পৌছেনা। তার সব রাগ ভাইয়ার কাছে গিয়ে শেষ হয়। যে কোন ভাবেই হোক ভাইয়া মুনার জন্য দেয়ালের মত দাড়িয়ে যায়। রাতে খাবার খাওয়ার পর মুনা আর পড়তে বসলোনা। বই খুললেই কেবল রাজিয়া মিসের কথা মনে পড়ে। সাগর নামের ওই ভাইয়াটার কথা মনে পড়ে। ওনাদের দুজনের কত কষ্ট। একজন তার ছেলেকে ফিরে পাচ্ছেনা আর আরেকজন তার মাকে। ওর মনটা ক্রমেই খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। কি একটা দরকারে যেন ভাইয়া মুনার ঘরে আসলো। আসার আগে দরজায় নক করলো মুনা ভিতরে আসবো? মুনা তখন গভীর চিন্তা মগ্ন। ভাইয়া বার কয়েক বলার পরও মুনার কোন উত্তর না পেয়ে ভাইয়া ওর রুমে ঢুকে দেখলো মুনা চুপচাপ বসে আছে। কাছে গিয়ে ভাইয়া চমকে উঠলো। মুনার চোখে পানি। কেউকি তবে ভাইয়ার অনুপস্থিতিতে মুনাকে বকেছে? নাকি মুনার শরীর খারাপ। ভাইয়া যে এসে ওর পাশে বসেছে মুনা সেটা টেরও পায়নি। ভাইয়া ওর কাধে হাতর রাখতেই মুনা ফিরে তাকাল। তাড়াতাড়ি চোখের পানি মুছে ফেললো। ভাইয়া বললো মুনা তোরকি মন খারাপ? কাদছিস কেন? কে তোকে কি বলেছে বল,আমি তাকে খুন করে ফেলবো। ভাইয়ার কথা শুনে মুনা ফিক করে হেসে দিল। বললো ভাইয়া ধর আব্বু বা আম্মু আমাকে বকেছে তাহলেওকি তুই খুন করবি? ভাইয়া বললো ধুর তোকে নিয়ে আর পারা যায়না। কথায় কথায় এমন ভাবে প্যাচ লাগাস যে আমি খেই হারিয়ে ফেলি। আরে তোর বাড়ি কি নোয়াখালি যে এতো যুক্তি দিস। মুনা ভাইয়ার কথা শুনে মুচকি হাসে। তারপর তার মনখারাপ কেন সেটা সে তার একমাত্র ভাইয়াকে খুলে বলে। মুনার মূখে সব শুনে মুনার ভাইয়ারও মনটা খারাপ হয়ে যায়। সে কথা দেয় যে কোন ভাবেই হোক এর একটা সমাধান বের করে ফেলবে। হঠাৎ হাতে কিল দিয়ে বললো পেয়েছি মিসির আলীর কাছে গেলে নিশ্চই তিনি এর সমাধান করে দেবেন। মুনার ভাইয়া মিসির আলীর ভক্ত। সে এতোটাই ভক্ত যে সে বিশ্বাস করে সত্যিই মিসির আলী নামে কেউ আছে। তাকে কোন ভাবেই বোঝানো যায়না যে মিসির আলী হুমায়ুন আহমেদের একটি গল্পের চরিত্র ছাড়া কিছু নয়। মুনা জোর করে ভাইয়াকে থামিয়ে দিয়ে বললো ভাইয়া আবার তুই মিসির আলীকে টানছিস। মিসির আলীর কথা আর মূখে আনবিনা। মিসির আলী একটি কাল্পনিক চরিত্র ছাড়া আর কিছু নয়। মুনার কথায় ভাইয়া কিছু বলেনা। শুধু বলে যাই হোক কিছুতো একটা করতে হবে। তুই ভাবতে থাক আমিও ভাবি। দেখি কিছু করা যায় কিনা। | |
|
Total comments: 0 | |